রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন:
সমাজে মাঝেমধ্যেই কিছু গুরুতর ইস্যু আলোচনায় চলে আসে। একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যে এসব বিষয় সব সময় সামনে আসে তা নয়; মাঝেমধ্যে ঘটনাক্রমে এবং দৈবক্রমেও চলে আসে। আর আমরা বিদ্যমান সামাজিক চৈতন্য থেকেই এ ধরনের বিষয় নিয়ে এক ধরনের ক্রিয়া কিংবা প্রতিক্রিয়া করি যাতে করে এসব সেনসেশনাল ইস্যু নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব, সমাজ মনস্তত্ত্ব ও অচেতন মনে লুকিয়ে থাকা অপ্রকাশিত অনেক কিছু প্রকাশিত হয়। এ রকমই একটি ইস্যু সম্প্রতি বাংলাদেশের জনপরিসরে বেশ আলোচনায় এসেছে। তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক লতা সমাদ্দারের ‘টিপ’ পরা নিয়ে একজন পুলিশ কনস্টেবলের আপত্তিকর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে জনপরিসরে টিপ সম্পর্কিত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভঙ্গি, সামাজিক মনস্তত্ত্ব এবং সমাজের বিদ্যমান ‘পেট্রিয়ার্কির’ একটা কালো চেহারা এর মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। তাই টিপ এখন শুধু একটা ললাট সাজানোর আলংকারিক অনুষঙ্গ নয়, টিপ এখন আমাদের বিদ্যমান সমাজের আয়নায় পরিণত হয়েছে। যে টিপের ভেতর দিয়ে আমরা এখন সমাজের অনেকের চেহারা চিনতে পারছি এবং নিজেদের চেহারাও খানিকটা দেখার সুযোগ পেয়ে গেছি।
মানুষ কবে থেকে প্রথম টিপের ব্যবহার করতে শুরু করে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ গবেষণালব্ধ তথ্য না-থাকলেও, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে নারীর সৌন্দর্যের বর্ণনায় টিপের উপমা-উৎপ্রেক্ষার নজির আছে। তাতে সহজেই অনুমেয় যে, টিপ বঙ্গ ললনার ললাট সাজানোতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে। মানুষের মধ্যে যখন থেকে নিজেকে নান্দনিক ও শিল্পিতভাবে উপস্থাপনার রীতি চালু হয়, ধারণা করা হয়, তখন থেকেই চোখে কাজল রেখার পাশাপাশি কপালে টিপ ব্যবহারের রীতি চালু হয়েছে। তবে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে প্রাচীনকালে টিপের ব্যবহার ছিল কি না তা নিয়ে কোনো অথেনটিক তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু আফ্রিকার নানান আদিবাসী এবং আমেরিকার বিভিন্ন ইন্ডিয়ানসদের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়েরই কপালে টিপ পরার রীতি প্রচলন ছিল এবং এখনো আছে। বেদ, মহাভারত ও রামায়ণেও নারী-পুরুষ উভয়েরই টিপ পরিধানের উল্লেখ আছে। এমনকি শাহি আমল, সুলতানি আমল এবং মুঘল আমলেও অনেক নারী-পুরুষ উভয়েরই কপালে টিপ ব্যবহারের নজির আছে। বিশেষ করে, যুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে কপাল ভাগ্য টিকা আকারে টিপ ব্যবহারের নজির পাওয়া যায় ইতিহাসের পরতে পরতে। কোনো কোনো অসমর্থিত সূত্র মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে টিপের ব্যবহার প্রায় পাঁচ হাজার বছরের। তবে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে টিপের ব্যবহারের সঙ্গে ‘হিন্দুয়ানি’ একটা লেবেল জুড়ে যায়, যা ছিল মূলত ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির অংশ। হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে নানান দ্বন্দ্ব তৈরি করে ব্রিটিশ শাসন জারি রাখার নানা পলিসির অংশ হিসেবে টিপের ব্যবহারের সঙ্গে হিন্দু ধর্মীয় একটা সেনসিটিভিটি যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য এবং জীবনাচারের ধর্মনিরপেক্ষ রীতিনীতির পরম্পরায় ১৯৭১ সালের পরও স্বাধীন বাংলাদেশের শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে টিপের প্রচলন প্রবলভাবে লক্ষ করা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালি নারীদের রুচিশীল সাজসজ্জা ও প্রসাধনসমাগ্রীর অনিবার্য অংশ হয়ে উঠে টিপ।
টিপ এখন নিয়মিত সাজসজ্জার একটি অতি সাধারণ আইটেম এবং নিত্য প্রসাধানসামগ্রীর অংশ। বাংলাদেশের শহরে এবং গ্রামে একটি আধুনিক, শালীন, সভ্য, রুচিশীল এবং ভদ্রোচিত সমাজে নারীর সাধারণ সাজসজ্জার অংশ হয়ে উঠেছে টিপ। আমাদের মা, বোন, বউ, বান্ধবী এবং কন্যারা টিপ পরে সমাজের সর্বস্তরে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করছে, কেননা আমরা জানি টিপ একজন মানুষের রুচি, মানসিকতা, সৌন্দর্যবোধ, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রতীক। এটাই আধুনিক সমাজব্যবস্থার সাধারণ রীতিনীতি। কিন্তু শুধু টিপ পরার জন্য লতা সমাদ্দারকে যেখানে অপমানিত হতে হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ফলে, সমাজের সর্বস্তরে এর তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। সংসদে টিপ ব্যবহারের স্বাধীনতা এবং আইনি বিধিবিধান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে এবং নিন্দার ঝড় উঠেছে। খোদ শিক্ষামন্ত্রী কপালে টিপ পরে ফেইসবুকে ছবি পোস্ট করে টিপ ব্যবহারের স্বাধীনতার দর্শনের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ লতা সমাদ্দারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের টিভি, সিনেমা ও মঞ্চের শিল্পীরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কপালে টিপ পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং লতা সমাদ্দারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি, এ ঘটনার দোষীকে গ্রেপ্তার করে, যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে। পুলিশও এরই মধ্যে অভিযুক্তকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে এবং প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, ‘একজন পুলিশ কনস্টেবল একজন নারীকে টিপ নিয়ে কটাক্ষ ও যৌন হয়রানি করেছে’, সুতরাং বিষয়টি দুজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত আচার ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ; বরং এটা এ সমাজের পুরুষত্ববাদী চরিত্র, কিছু মানুষের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী-বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা এবং নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ।
এ ঘটনার ভেতর দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আছর তীব্র হিন্দু-বিদ্বেষের মধ্য দিয়ে অবগুণ্ঠিত হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি, নারীর পোশাক এবং প্রসাধনীর প্রতি সমাজের কিছু পুরুষের যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভঙ্গি যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় সমাজমনস্তত্ত্ব সেটার একটা চেহারা-সুরত আমরা দেখতে পেলাম।
যে দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, যে দেশের পার্লামেন্টের স্পিকার একজন নারী, যে দেশের শিক্ষামন্ত্রী একজন নারী, যে দেশের মানব উন্নয়ন সূচকে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবার কাছে সমীহযোগ্য, সেখানে নারীর প্রতি এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনোভঙ্গি আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ টিপকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক চলছে, তার পক্ষে যেমন একটা বড়সংখ্যক মানুষ অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং একটা প্রগতিশীল মনমানসিকতা নিয়ে হাজির হয়েছে, ঠিক একটা বড়সংখ্যক মানুষ টিপ পরিধানকে একটা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি এবং অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব নিয়ে নির্বিকার গালাগাল করছে। আরও লেখা বাহুল্য, যেসব শিল্পী নিজেদের কপালে টিপ পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ধরনের প্রতীকী প্রতিবাদ করে লতা সমাদ্দারের পাশে দাঁড়ানোর নৈতিক, সামাজিক, ও বিবেকোচিত কাজ করেছে, তাদের হজম করতে অত্যন্ত অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ এবং অশ্রাব্য সাইবার বুলিং। এর মধ্য দিয়ে কী প্রমাণিত হয়?
আমি এটা মনে করি না যে, সমাজের সব মানুষ একইভাবে চিন্তা করবে। সবাই একই মনমানসিকতার হবে। কিন্তু টিপ পরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমাজে একটা বড়সংখ্যক মানুষের এ ধরনের নেতিবাচক মানসিকতা এবং প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাভাবনা সমাজের নারীর অধস্তন অবস্থান এবং নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজ-মনস্তত্ত্ব আমাদের নতুন নিজের চেহারাটাকেই চেনার মওকা তৈরি করে দিয়েছে। সুতরাং, টিপ আমাদের সামনে একটা আয়না হিসেবে হাজির হয়েছে। তাই, আমরা যেন নিজেদের এবং অন্যদেরও চিনে রাখি।
লেখক নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়